সিলেটে আসার আগে অনেকেই কনফিউজড থাকেন কোথায় যাবেন বা কিভাবে ট্যুর প্ল্যান সাজাবেন। সিলেটের মুল ট্যুরিস্ট প্লেস মুলত সাদাপাথর বা ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, জাফলং । দেখার দিক থেকে ৩ টা স্পটই মুলত কাছাকাছি। এরপাশেও কিন্তু আরো নানান সুন্দর সুন্দর স্পট রয়েছে। যেগুলো হচ্ছে; লালাখাল, চা বাগান, রাতারগুল, পানতুমাই, আলুরতল, কিন ব্রিজ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় । এছাড়াও সিলেট জেলার বাইরে রয়েছে সুনামগঞ্জ এর নারায়নতলা, টেকেরঘাট , শিমুল বাগান, হাকালুকি হাওড়, টাংগুয়ার হাওর এবং চায়ের রাজধানি শ্রিমংগল ।
একেক ঋতুতে সিলেটে আসলে আপনাকে একেকভাবে ট্যুর প্ল্যান সাজাতে হবে ।বর্ষায় পাহাড় অনেক সবুজ থাকে আবার নদীতে পানিও বেশি থাকে । হাওড় দেখার জন্য বর্ষা আদর্শ সময় । চা বাগান ও সবুজ থাকে বেশি । সব ঋতু মিলিয়ে এখানে আপনাদের জন্য ডে ওয়াইজ একটু ট্যুর প্ল্যান দেয়ার চেস্টা করলাম। পরবর্তী তে ঋতু অনুযায়ী আলাদা একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা থাকবে।
ডে ১ঃ সিলেট থেকে যেহেতু ভোলাগঞ্জ বা সাদাপাথর কাছে তাই প্রথমদিন ভ্রমনের ঝাকি এড়াতে আপনি চলে যেতে পারেন ভোলাগঞ্জ । তবে শিতকালে এলে এখানে শুধু পাথর পাবেন, পানি পাবেন খুব অল্প । সিলেট থেকে এখানে যেতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা । বাসে এক ঘন্টা এবং নৌকার পথ রয়েছে আধাঘন্টা । শহররের আম্বরখানা থেকে বাসে অথবা সিএনজিতে করে চলে যেতে পারেন এক্ষেত্রে ভাড়া সাশ্রয় হবে । সকাল ৮ টার দিকে রওনা দিয়ে ৩.৩০ টার দিকে যদি এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন তবে বিকালে মালনিছড়া চা বাগান ঘুরে দেখতে পারবেন । ফেরার পথে মালনীছড়া কা বাগান শহরের পাশেই , অনেকেই দেরি করে ফিরে বলে আসার পথে চা বাগান দেখতে পারেন না । যারা গাড়ি ভাড়া করে যাবেন তারা অবশ্যই শুরুতে মালনিছড়া ঘুরে তারপর যাবেন কারন মুল স্পটে বেশি সময় কাটানর ফলে অনেকেই মালনিছড়ার সৌন্দর্য মিস করেন।
সতর্কতা: চা বাগানে ভ্রমনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির দিনে জোক এর ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। যদি আরও আগে বের হতে পারেন, তবে ওইদিন ই ঘুরে আসতে পারেন রাতারগুল সোওয়াম্প ফরেস্ট । তখন ফেরার পথে উঠতে পারেন মালনিছড়া চা বাগান । যারা সাদা পাথরের পরিবর্তে বিছানাকান্দি যেতে চান তারা বিছানাকান্দির সাথে ঘুরে আসতে পারেন রাতারগুল। সাদা পাথর ও বিছনাকান্দির দৃশ্য প্রায় কাছাকাছি । তবে সাদা পাথর যাওয়া তুলনামূলক সহজ। সন্ধার পর চা খেয়ে রাতে শহর দেখতে চলে যেতে পারেন চউহাট্টা পয়েন্টে থাকা শহিদ মিনার দেখতে । সেখান থেকে কিন ব্রিজ কাছেই। নদির পারে দাঁড়িয়ে চা পান করতে করতে সাজিয়ে নিতে পারেন দ্বিতীয় দিনের ভ্রমন পরিকল্পনা । আর হরেক পদের ভর্তা দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিতে পারেন পাঁচ ভাই অথবা পানসি রেস্তোরায় ।
আগেই বলে নিচ্ছি, সাদাপাথর, বিছানাকান্দি এবং জাফলং দেখতে প্রায় একি রকম । তিন জায়গাতেই রয়েছে নদির পাশে পাথরের উপর সবচ্ছ পানির প্রবাহ। যদি প্রথম দিনে রাতারগুলে যেতে না পারেন দ্বিতীয় দিন আপনি সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন রাতারগুল এবং সেখান থেকে লালাখাল ও জাফলং, আর সময়টা হয় যদি বর্ষাকাল আর শাপলা ফোটার সময় তবে সাথে ডিবির হাওড় । বর্ষাকাল ছাড়া যদি ঘুরতে আসেন তবে দ্বিতীয় দিনের মাস্ট সি অপশনে লালাখালকে রাখবেন । কারন বাকি স্পটগুলোর চাইতে এটা একটু আলাদা । আর বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঝক্কি না নিতে চাইলে বাদ দিবেন ডিবির হাওর । প্রথমদিন রাতারগুল মিস করে গেলে খুব সকালে বের হয়ে চলে যেতে পারেন রাতারগুল । সেখান থেকে লালাখাল । যেতে সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘন্টা। আগেই বলে দিচ্ছি, রাতারগুল থেকে লালাখাল যাওয়ার কিন্তু কোন লোকাল পরিবহন নেই । আপনাকে রিজার্ভ করে অথবা ভেংগে ভেংগে যেতে হতে পারে।
রাতারগুল থেকে সারিঘাট যাওয়ার পর নৌকা দিয়ে লালাখাল চলে যাবেন । নিল পানিতে কিছুটা সময় কাটীয়ে সেখান থেকে বিকালে চলে যেতে পারেন জাফলং । যাওয়ার পথে নেমে দেখবেন জইন্তার পাহাড় । জাফলং এ গোসল করে সেখান থেকে সন্ধ্যায় একবারে চলে আসবেন সিলেটে । জাফলং গেলে মায়াবী ঝর্না মিস করবেন না। এখানে বর্ষাকালে পানি পাবেন। শীতে গেলে পাবেন না । এভাবে বেশি স্পট ঘুরে দেখতে চাইলে গাড়ি রিজার্ভ করে নেয়াই ভাল, চাইলে লোকাল বাসেও দেখতে পারবেন এক্ষেত্রে সময় লাগবে একটু বেশি । আর যদি লালাখাল থেকে জাফলং যেতে না চান তবে চলে যেতে পারেন পান্তুমাই ।
# বর্ষাকাল ছাড়া পানতুমাই ভ্রমনে গেলে আপনাকে হতাশ হয়ে ফেরা লাগতে পারে । খুব সকালে বের হতে পারলে মোটামুটি সব স্পট কাভার করা সম্ভব তবে এক্ষেত্রে পান্তুমাই বাদ দিবেন আপনার ভ্রমনের তালিকা থেকে । সময় দিতে না পারলে এই ভ্রমন উপভোগ করতে পারবেন না । দ্বিতীয় দিন ভ্রমনের ক্লান্তি বেশি । তাই রাতে শহরের ভেতরেই রিকশা নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন । যদি সুইমিং করতে চান তাহলে চলে যেতে পারেন শহরের মজুমদারিতে । সেখানে বিশাল একটি সুইমিং পুল রয়েছে । নাম ব্রিটানিয়া সুইমিং পুল ।
ডে ৩ঃ সকালে উঠেই আপনাকে চলে যেতে হবে সুনামগঞ্জ । শহর থেকে লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা । সিলেটের কুমারগাও বাস স্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জের বাস পাওয়া যায় । বর্ষায় গেলে ঘুরে আসতে পারেন টানগুয়ার হাওর ওয়াচ টাওয়ার আর শিতে গেলেঃ নারায়ন্তলা, যাদুকাটা নদি , শিমুল বাগান, টেকেরঘাট । বর্ষার সময় গেলে ঘুরে আসতে পারেন হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ার আর শিতের সময় গেলে শিমুল বাগান ও টেকেরঘাট । তবে হাওড়ে যেতে চাইলে একদিনে প্ল্যান না করে দুইদিনে করাটাই ভাল হবে । তবে সুনামগঞ্জ এর দৃশ্য কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা । হুট করে পাহাড়ের পাশে ধানক্ষেত দেখলে মনে হবে দেশের বাইরে চলে এসেছেন ।
আর সিলেট থেকে যাওয়া আসাতে প্রায় ৭ থেক ৮ ঘন্টা লাগবে তাই ফ্যামিলিট ট্যুরের ক্ষেত্রে বা বাচ্চা সাথে থাকলে একটু ভেবে দেখবেন । যদি সুনামগঞ্জ যেতে না পারেন তবে যেতে পারেন শমসেরনগর লেক ও ক্যামেলিয়া টি গারডেন এ সাথে শহরে ফিরে এমসি কলেজ, আলুরতল আর রাস্তা ভাল থাকলে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান । জাতীয় উদ্যান কিন্তু ৫ টায় বন্ধ হয়ে যায়।
ডে ৪ঃ যদি আপনার ট্যুর ৩ দিনের থাকে এবং সুনামগঞ্জকে তালিকা থেকে বাদ দিতে চান তবে শেষ দিনে রাথতে পারেন শ্রিমংগলকে । সিলেট থেকে ট্রেনে ও বাসে খুব সহজে মাত্র ২ থেকে আড়াই ঘন্টায় শ্রিমংগল ঘুরে আসতে পারবেন । সারাদিন শ্রিমংগলের চা বাগানে ঘুরে যেতে পারেন মাধবপুর লেক আর লাউয়াছড়া । আপনি যদি ঢাকা বা অন্যান্য জায়গা থেকে আসেন তবে আবার সিলেট ব্যাক না করে, শ্রিমংগল থেকেই বাসে বা ট্রেনে করে আপনি ব্যাক করতে পারবেন এতে আপনার সময় ও অর্থ দুইটাই সাশ্রয় হবে । শ্রিমংগলে রয়েছে অনেকগুলো সুন্দর চা বাগান । ফেরার পথে চা পাতা নিতে ভুলবেন না ।
এভাবে একটু পরিকল্পনা করে ঘুরে আসলে আপনি অনেক বেশি জায়গা ঘুরে দেখতে পারবেন একি সাথে আপনার সময় ও সাশ্রয় হবে। বর্ষাকালে এলে গুরুত্ব দিবেনঃ সাদাপাথর , রাতারগুল, চা বাগান , ডিবির হাওর, পান্তুমাই এবং টাংগুয়ার হাওরকে আর শিতকালে এলে, লালাখাল, শিমুল বাগান, নিলাদ্রি এবং জাফলং অথবা বিছানাকান্দিকে। সব মিলিয়ে আপনার ভ্রমন পরিকল্পনা এমন ভাবে হওয়া উচিত যাতে আপনার ভ্রমনে ক্লান্তি কম থাকে এবং আপনি পরিপুরন ভাবে ভ্রমন উপভোগ করতে পারেন । তাই আমি মনে করি একিদিনে আপনার অনেক বেশি ভ্রমনের চাইতে আপনি যদি সময় নিয়ে সবকিছু দেখতে পারেন তবে আপনার এই ভ্রমন সার্থক হবে।
সব শেষে অনুরোধ করি, ভ্রমনের সময় পানির বোতল, চিপ্স এর প্যাকেট বা খাবারের প্যাকেট এগুলো যেখানে সেখানে না ফেলে নিরদিস্ট স্থানে ফেলুন । আমাকের ভ্রমন স্পট গুলোকে আমরা সুন্দর রাখি । অন্য ভ্রমনকারিদের যাতে কোন সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখি।